Saturday, August 12, 2017

চোখের জলই ভরসা পাবনার বৃদ্ধ ‘নাইট রিকশাওয়ালাদের’


জীবনের যে সময়ে এসে পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে দিন অতিবাহিত করার কথা, নাতি-নাতনিসহ রাতের খাবার শেষে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসার কথা- সেই সুন্দর মুহূর্তগুলো হারিয়ে গেছে পাবনার অনেক বৃদ্ধ রিকশাচালকের জীবন থেকে। এই বয়োবৃদ্ধদের অনেকেই কেবল রাতে রিকশা চালান।
রাতের বেলায় যাঁরা রিকশা চালান, সেই চালকরা পাবনা শহরে নাইট রিকশাওয়ালা নামে পরিচিত। যে রিকশা চালিয়ে এই বৃদ্ধ বয়সেও তাঁরা নিজেদের ভাগ্যের চাকা ঘোরাচ্ছেন সেটাও আবার নিজের নয়, চড়া সুদে কিস্তিতে কেনা।
প্রতিদিন ১৫০ টাকা হারে সপ্তাহে এক হাজার ৫০ টাকা জমা দিতে হয় রিকশার মহাজনকে। সেই সঙ্গে প্রতিদিন ব্যাটাজি চার্জ দিতে খরচ হয় আরো ৫০ টাকা।
ফলে যে টাকা রিকশা চালিয়ে আয় হয় তার সিংহভাগই চলে যায় কিস্তি পরিশোধ করতে। এ সীমিত টাকায় ওই নাইট রিকশাওয়ালাদের জীবনধারণ দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।
এমনই একজন রিকশাওয়ালা পাবনা সদর উপজেলার আরিফপুর হাজিরহাট এলাকার শতবর্ষী রফিকুল ইসলাম। যিনি দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে রিকশা চালাচ্ছেন। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ছয় কাঠা জমি ছিল, যার তিন কাঠা মাদ্রাসা আর বাকি তিন কাঠা রাস্তার জায়গার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, দরিদ্র হলেও উদার মনের অধিকারী এই রিকশাচালক এই দানের বিনিময়ে কোনো অর্থ নেননি।
রফিকুল ইসলাম দুই ছেলে ও ছয় মেয়ের বাবা। বৃদ্ধ এই রিকশাচালক জানালেন, অর্থের অভাবে ছেলেদের পড়াশোনা করাতে পারেননি। ছেলেদের কেউই ভালো চাকরি পাননি। ছেলেরা যা আয় করে, তাতে তাঁদের নিজের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসার চলে না।
ফলে একরকম বাধ্য হয়েই পাবনার রাধানগর এলাকার লেপু সিপাহী রোডে ছোট মেয়ের বাড়িতে থাকেন রফিকুল ইসলাম। সরকারি বয়স্কভাতা পান প্রতি তিন মাসে ৫০০ টাকা করে মোট এক হাজার ৫০০ টাকা। প্রতি মাসে রাতভর রিকশা চালিয়ে খরচ বাদে তাঁর গড়ে আয় হয় তিন হাজার ৭০০ টাকা থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত।
এ টাকায় মাস কাটানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন রফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, বৃদ্ধ বয়সে রোগব্যাধি তো নিত্যসঙ্গী। এ সীমিত টাকায় ওষুধ কিনে জীবন চালানো কঠিন।
রফিকুল ইসলামের মতোই আরেক নাইট রিকশাওয়ালা সদর উপজেলার দোগাছী ইউনিয়নের আশুতোষপুর গ্রামের বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমান (৬৫)। তিনি রিকশা চালান ৪০ বছর ধরে। সরকারের বয়স্ক ভাতা পান না। রাতভর রিকশা চালিয়ে প্রতি মাসে খরচ বাদে আয় করেন চার হাজার টাকা থেকে চার হাজার ২০০ টাকা। তাঁর ছেলে নেই, শুধু দুটি মেয়েসন্তান। অভাব-অনটনের কারণে ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারেননি। প্রতি সপ্তাহে তাঁকেও রিকশার কিস্তি দিতে হয়।
সিদ্দিকুর রহমান জানান, জামাইদের খুশি রাখতে অনেক সময় মেয়েদেরকেও কিছু দিতে হয়। কিন্তু তাঁর এই সীমিত আয়ে নিজেই চলতে পারেন না, জামাইদের দেবেন কী! ফলে বেশ বিপাকেই আছেন সিদ্দিকুর।
পাবনা শহরের কাচারীপাড়া মহল্লার বাসিন্দা আক্কাস শেখ (৬১) রিকশা চালাচ্ছেন প্রায় ৩৬ বছর ধরে। তিনিও রাতের বেলায় রিকশা চালান। দিনে অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারেন না বলে রাতে এই রিকশা চালনা। এ ছাড়া রাতে কম দূরত্বে বেশি ভাড়া মেলে বলেও জানালেন তিনি।
আক্কাস শেখের দুই ছেলে। বিবাহিত দুই ছেলেই অন্যের দোকানে কাজ করেন। এই আয়ে নিজেদেরই সংসার ঠিকমতো চলে না, বাবাকে কীভাবে দেখাশোনা করবেন। তাই এ বৃদ্ধ বয়সেও রাতে রিকশা চালাতে হয় তাঁকে।
আক্কাস শেখ জানান, রাতভর রিকশা চালিয়ে খরচ বাদে প্রতি মাসে তাঁর গড়ে আয় হয় চার হাজার ৩০০ টাকা থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা পর্যন্ত। আর এই সীমিত আয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে মহাসংকটে আছেন তিনি।
শুধু আক্কাস, সিদ্দিকুর ও রফিকুল ইসলামই নন- তাঁদের মতো আরো অর্ধশত বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা আছেন, যাঁরা অল্প উর্পাজনে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এরপরও রয়েছেন নানা সংকটে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অসহায়ত্ব আর নিভৃতে-নীরবে চোখের পানি ঝরানো যাদের চলার পথে একমাত্র ভরসা।

No comments:
Write comments

About us

Lorem Ipsum is simply dummy text of the printing and typesetting industry. Lorem Ipsum has been the industry's standard dummy text ever since the 1500s, when an unknown printer took a galley of type and scrambled it to make a type specimen book

Services

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

More Services

© 2014 Pabna Guide. Template Designed by Bloggertheme9